অনলাইন ডেস্ক :
নড়াইলের দীঘলিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার ১০ দিন পেরোলেও শুকায়নি ক্ষত। সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, দোকান ও মন্দিরের গায়ে এখনও আছে পোড়া দাগ।
মঙ্গলবার সেই এলাকা দেখতে যান বিভিন্ন মানবাধিকার ও আদিবাসী সংগঠনের নেতা, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেন এবং হামলার শিকার মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাঁরা লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুন্সী আলাউদ্দিন, ইউএনও আসগর আলী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সহিংসতার ভয়াবহতার যে বিবরণ শুনেছেন, তা অবহিত করেন।
বিশিষ্টজনের দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খায়রুল চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, সাংবাদিক নজরুল কবীর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, মুনতাসির জাহিদ, গৌতম কুমার দেওয়ান, দীঘলিয়া রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা প্রমুখ।
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, নড়াইল পরিচিত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জেলা হিসেবে। এখানকার একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। তবে দীঘলিয়ায় যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখজনক। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। শুনেছি, এখনও অনেকে বাড়িতে ফেরেননি। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের মনের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। দেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা। এই মূলনীতির বাস্তবায়নে স্থানীয়দের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের বসতে হবে, শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
আবু সাঈদ খান বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশ প্রশাসন যথাযথ ভূমিকায় থাকলে দীঘলিয়ার সাহাপাড়ার এই চিত্র আজ দেখতে হতো না। হামলার শিকার মানুষের মন ও হৃদয় ভেঙে গেছে। এটা মেরামত ও তাঁদের পাশে থাকা দরকার। শুনেছি ‘৭১-এ পাকিস্তানি হানাদাররা এ গ্রামে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ঠিকই প্রবেশ করেছে। তারা অন্য কেউ নয়, আমাদের সমাজেরই; কিন্তু ফের নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে তাদের নাম কেউ বলছে না। তাদের খুঁজে বের করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটা ধারাবাহিক ঘটনার অংশ। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৩৫০টির মতো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার মন্দির ভাঙচুর হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একটিরও বিচার হয়নি। এই প্রবণতাই মানুষকে অপরাধে ধাবিত করছে।
গত ১৫ জুলাই দীঘলিয়ার সাহাপাড়ার কলেজছাত্র আকাশ সাহা ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। হামলা হয় দীঘলিয়া বাজার, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে। আক্রান্ত হয় স্থানীয় নিত্য সাহা ও অশোক সাহার মুদি দোকান, গোবিন্দ কুণ্ডু ও গৌতম কুণ্ডুর মিষ্টির দোকান, অনুপ সাহার ওষুধের দোকান, সুবল সাহা ও মাহাবুব মিয়ার চায়ের দোকান এবং সাহাপাড়ার শিবমন্দির, শ্মশান কালীমন্দিরসহ বেশ কয়েকটি উপাসনালয়।
ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পরদিন আটক করা হয় কলেজছাত্র আকাশকে। পরদিন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন দীঘলিয়া গ্রামের সালাউদ্দিন কচি। সেই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গতকাল তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়।
এদিকে আকাশের পোস্টকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় ১৭ জুলাই অজ্ঞাতপরিচয় ২৫০ জনের নামে মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লোহাগড়া থানার এসআই মিজানুর রহমান বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা সবাই কারাগারে।
সূত্র: সমকাল