প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুঃ
প্রবারণা বৌদ্ধদের কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিন মাস অবধি সময়কে বৌদ্ধ পরিভাষায় বর্ষাবাস বলা হয়। এই সময়টাকে বর্ষা যাপনও বলা হয়। বৌদ্ধদের কাছে বর্ষা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুখ, দুঃখ, ভাল-মন্দে, দান, শীল (নীতি), ভাবনা তথা ত্রিপিটক সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বর্ষা বৌদ্ধদের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধের সময়ে ভিক্ষুসংঘ দেব-মানবের কল্যাণে ধর্ম প্রচারের জন্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তেন, বিচরণ করতেন। তাঁদের এই অভিযান কোন পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ছিল না। পরহিত বা কল্যাণ সাধনই ছিল মূল লক্ষ্য। বর্ষা ঋতুতে চতুর্দিকে বিচরণ করা দুঃসাধ্য ছিল। এই সময়ের মত তখনও প্রকৃতির তান্ডব লীলা চলত সময়ে সময়ে। এই সমস্ত কারণে ভিক্ষুসংঘকে কোন এক জায়গায় স্থির থেকে বুদ্ধ বর্ষাঋতু পালনের জন্য ভিক্ষুসংঘকে কিছু নিয়ম নীতিও বেঁধে দেন। তিন মাস ব্যাপী বর্ষাঋতু উদযাপনের বিধি বিধান এবং বিনয় সমৃদ্ধ এই পদ্ধতিকে বলা হয় বর্ষাবাস বা বর্ষাব্রত। তিনমাস ব্যাপী বর্ষাব্রতের পর আসে প্রবারণা। প্রবারণা পর্বটি মূলত ভিক্ষুসংঘদের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রবর্তিত।

প্রবারণা কি :
বুদ্ধের সময়ে শত শত এমনকি হাজার হাজার ভিক্ষুসংঘ একই স্থানে একসাথে অবস্থান করে ধর্ম বিনয় শিক্ষা করতেন। যেখানে দ’ুজন একসাথে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে বিভিন্ন ধরনের মতবিরোধ এবং মনোমালিন্য হয় সেখানে একত্রে এত সংখ্যক ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করলে মনের অজান্তে অনেক ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। এবং হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে সেটা কখনো কাম্য নয়। একে অপরের প্রতি সদা মৈত্রীভাব পোষণ করাই তাঁদের নিত্যদিনের ব্রত। বলা যায়, প্রবারণা মানে ভুল ত্রæটির নির্দেশ। আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ ও ধ্যান শিক্ষা সমাপ্তি। সকল প্রকার ভেদাভেদ গøানি ভুলে গিয়ে কলুষমুক্ত হওয়ার জন্য ভিক্ষুসংঘ পবিত্র সীমা ঘরে সম্মিলিত হয়ে একে অপরের নিকট দোষ স্বীকার করেন। নিজের দোষ স্বীকারের মধ্যে মহত্ত¡তা আছে এ শিক্ষাকে ধারণ করা হয়। মানুষ মাত্রেই চেতন কিংবা অবচেতন মনে ভুল করতে-ই পারে। সেই ভুলকে দৃঢ়তার সাথে স্বীকার করে সংশোধনের প্রচেষ্টায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াইতো জীবনের সার্থকতা। আভিধানিক বিচারে প্রবারণার অর্থ হল বরণ করা আর বারণ করা। অর্থাৎ সকল প্রকার অকুশল বা পাপকর্ম বর্জন বা বারণ করে কুশল কর্ম বা পূণ্যকর্ম সম্পাদন বা বরণ করার শিক্ষা প্রবারণা দিয়ে থাকে।
প্রবারণার বিধান প্রজ্ঞপ্তি :
মহাকারুনিক বুদ্ধ তখন শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। কোশলরাজ্য হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিক্ষুসংঘ বর্ষাবাস শেষে বুদ্ধ দর্শনে আসলেন। বুদ্ধের সাথে তাঁদের কুশলাদি বিনিময় হল। বুদ্ধ তাঁদের কাছ থেকে কীভাবে তাঁরা বর্ষাবাস উদযাপন করেছেন তা জানতে চাইলেন। তাঁরা উত্তর দিলেন পরস্পরের সাথে বাদ-বিসংবাদ এড়াবার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে মৌনভাবে বর্ষাবাস অতিবাহিত করেছেন। বর্ষাব্রতের সমাপ্তিতে তাঁরা কেউ কারো সাথে কোন ধরনের বাক্যালাপ না করে মৌনভাব বজায় রেখে বুদ্ধ দর্শনে এসেছেন। তাঁদের কথা শুনে শাস্তা বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। বুদ্ধের মৃদু হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে পড়ছে। এতটা সময় ধরে একসাথে থাকার পরেও কোন ভাব বিনিময় না করে থাকতে পারাটাও কম কিসের ! কতটা সংযমী হলে তা সম্ভব হয় তা বুঝতে না পারার কোন কারণ নেই। করুণাময় বুদ্ধ তাঁেদর উপদেশ দিলেন, “ভিক্ষুসংঘ একসাথে অবস্থান করলে মৌনব্রত পালন বিধেয় নয়। তোমাদের এরূপ আচরণ প্রশংসাযোগ্য নয়। বর্ষাবাস শেষে তোমরা প্রবারণা উদযাপন করবে। একে অপরের প্রতি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। একস্থানে থাকা কালীন একজন অপর জনকে অনুশাসন করলে উভয়েরই কল্যাণ হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়। এতে সমগ্র ভিক্ষু সংঘের শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়”। অতপর তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে আহবান করে বাধ্যতা মূলকভাবে প্রবারণা উদযাপনের বিধান প্রবর্তন করেন। বিনয় বিধান অনুসারে প্রবারণা ২ প্রকার। ১) পূর্বকার্তিক প্রবারণা ২) পশ্চিম কার্তিক প্রবারণা
পূর্ব কার্তিক প্রবারণাঃ
আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করে আশ্বিনী পূর্ণিমায় যে বর্ষাবাস সমাপ্ত হয় তাকে পূর্বকার্তিকী প্রবারণা বলে।
পশ্চিম কার্তিক প্রবারণাঃ
আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বর্ষাবাস আরম্ভ করেও মাস পর যে প্রবারণা অনুষ্ঠিত হয় তাকে পশ্চিম কার্তিকী প্রবারণা বলে। এই দ্বিবিধ বর্ষাবাসকে যথাক্রমে ১ম বর্ষাবাস ও ২য় বর্ষাবাস বলে।
ভিক্ষু সংঘের পাশাপাশি বৌদ্ধ উপাসক উপাসিকাদের জন্যও প্রবারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবারণা উদযাপনের পর পর তারা মাস ব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসবে মেতে উঠেন। প্রবারণার অনন্য আরো কয়েকটি ঘটনা আছে। যেমনঃ
স্বর্গ থেকে বুদ্ধের মর্ত্যলোকে অবতরণঃ
বুদ্ধের মতে প্রত্যেক ব্দ্ধুমাতা প্রথম সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পরে মৃত্যবরণ করেন। এবং মৃত্যু পরবর্তী তাবতিংস স্বর্গে অবস্থান করেন। একইভাবে গৌতম বুদ্ধের মাতা মহামায়া ও সিদ্ধার্থের (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) জন্মের এক সপ্তাহ পরে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাবতিংস স্বর্গে উৎপন্ন হন। কারণ বুদ্ধমাতার গর্ভে দ্বিতীয় সন্তান আসতে পারে না। এছাড়াও জগতে এক সাথে দুজন সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন না। একজন মাত্র সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন। ভদ্রকল্পের পঞ্চবুদ্ধের মধ্যে বর্তমান চলছে চতুর্থতম বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধের শাসন। গৌতম বুদ্ধের শাসন বিলুপ্তির পরে ভদ্রকল্পের শেষ বুদ্ধ আর্যমৈত্রীয় বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন। এই সম্পর্কে গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ সবিস্থারে বর্ণনা করেছেন। তিনি বিমাতা গৌতমীর কাছে লালিত পালিত হলেন। এইজন্য তাঁকে গৌতম বুদ্ধ বলা হয়। ক্রমান্বয়ে তিনি ৩৫ বছর বয়সে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব ফল লাভ করলেন।
তিনি দিব্যজ্ঞানে মাতৃদেবীর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হলেন। মাতাকে দুঃখমুক্তি দানের মানসে বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে গমন করলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। সেখানে তিনমাস অবধি অভিধর্ম পিটক (চিত্ত চৈতসিক সম্পর্কে বিশদ ব্যাখা) দেশনা করে মাতাকে মুক্তিমার্গ দান করেছিলেন। সাথে অসংখ্য দেব ব্রহ্মা ও ধর্মচক্ষু লাভ করেছিলেন। অতপর বর্ষাবাসের পরে তথাগত বুদ্ধ স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেছিলেন। সেদিন ছিল শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। আর সেটি ছিল বুদ্ধের জীবনের সপ্তম বর্ষাবাস। মর্ত্যলোকে অবতরণের সময়ও এক অবিনাশী স্মৃতিময় ঘটনা ঘটে যায়। বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে বর্ষাবাস যাপনকালীন মাতৃদেবীকে উদ্দেশ্য করে ধর্মদেশনা করলেও পর সেই দেশনাবলি ছিল দেব উপযোগী। আগেই বলা গেছে যে, সেই দেশনায় অসংখ্য দেব ব্রহ্মা ধর্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তখন দেব পরিষদ চিন্তা করলেন তারা কিভাবে বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারেন। বিশ্বকর্মা দেবপুত্র বুদ্ধের সম্মানে দৈব শক্তিতে তাবতিংস স্বর্গ থেকে ভারতের সাংকাশ্য নগর পর্যন্ত তিনটি স্বর্গীয় সিঁড়ি রচনা করলেন। মধ্যখানের সিঁিড় ছিল মণিমুক্তা খচিত, বামপাশের সিঁিড় ছিল রোপ্য খচিত এবং ডানপাশের সিঁড়ি ছিল স্বর্ণ খচিত। বুদ্ধ মাঝখানের সিড়ি দিয়ে দেবলোক হতে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেছিলেন। ডানপাশের সিঁড়ি বেয়ে মহাব্রহ্মাসহ ব্রহ্মাগণ শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করেছিলেন। বামপাশের সিঁড়ি বেয়ে দেবগন বুদ্ধের প্রতি দিব্যপুষ্প বর্ষণ করতে করতে সাধু সাধু ধ্বনিতে আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত করে বুদ্ধের গুণকীর্তন করোছিলেন। সেদিন স্বর্গ-মর্ত্য একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ছিল এমন এক বিরল এবং দুর্লভ সময় সন্ধিক্ষণ যেই ক্ষণে দেবতা এবং মানুষ সরাসরি পরস্পরকে দর্শন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ভারতের সেই সাংকাশ্য নগরী এখনো পর্যন্ত বৌদ্ধদের জন্য পবিত্র তীর্থধাম হয়ে আছে। এবং ত্রিপিটকে উল্লে¬খ আছে যে, প্রত্যেক সম্যক সম্বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গ থেকে উক্ত সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করবেন। এটিকে অপরিবর্তনীয় স্থানও বলা হয়।
গঙ্গানদী পথে বুদ্ধের বৈশালী গমনঃ
বুদ্ধের সময় বৈশালী ছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। এক প্রতাপশালী রাজবংশ বৈশালীকে শাসন করতেন। কথিত আছে যে, ক্ষত্রিয় বংশের সাত হাজার সাতশত সাত জন রাজা বৈশালীকে ক্রমান্বয়ে শাসন করেছিলেন। ধন ধান্যে পরিপূর্ণ বৈশালীতে হিংসাত্ত¡ক তান্ডব, বাদ-বিসংবাদ বলতে কিছুই ছিল না। রাজা, প্রজা, রাজ্য রাজত্ব যেন একই সুতোয় গাঁথা। হঠাৎ উক্ত রাজ্যে ত্রি উপদ্রব দেখা দিল। দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অমনুুষ্যের উপদ্রবে রাজ্যের মানুষ দুর্বিসহ জীবনের ভার টানতে শুরু করলেন। রাজ্যের অশান্তি এবং প্রজাদের ভোগান্তি রাজাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করল। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি। তরবারি দিয়ে কিংবা চতুরঙ্গিনী সেনাদল দ্বারা তো এর সমাধান হবে না। প্রজাবৎসল রাজার মনের প্রতিটি কোণে কষ্ঠ জমাট বাঁধতে শুরু করল। রাজা এবং অমাত্যবর্গ পরিত্রাতা বুদ্ধের শরণে যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন। বুদ্ধ তখন রাজা বিম্বিসার কর্তৃক দানকৃত পূর্বারাম বিহারে অবস্থান করছিলেন। বৈশালীবাসীর পক্ষে মহালি লিচ্ছবিও রাজা পুরোহিত পুত্রকে নৃপতি বিম্বিরারের কাছে পাঠানো হল। তারা প্রেরিত সংবাদটি রাজকীয় শিষ্ঠাচার বজায় রেখে রাজার সামনে নিবেদন করলেন। বৈশালীর কল্যাণে রাজা প্রমূখ প্রেরিত প্রতিনিধিগন বুদ্ধকে সবিনয়ে ফাং (নিমন্ত্রণ) করলেন। বুদ্ধ পাঁচশত ষড়াবিজ্ঞ অর্হৎ সহ বৈশালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বুদ্ধ অন্তপ্রাণ রাজা বিম্বিসার বুদ্ধের যাতে কষ্ট না হয় গমনা গমনের সকল রাস্তা সুসজ্জিত করে দিলেন। রাজগৃহ এবং গঙ্গার মধ্যখানে পাঁচযোজন ভূমি স্থান করে প্রতিযোজন অন্তর অন্তর জানুপ্রমাণ গভীর পঞ্চবর্ণের পুষ্পরাজি ছিটিয়ে দিলেন। ধ্বজা পতাকা ও কদলী বৃক্ষাদি প্রোথিত করলেন। ছোট এবং বড় দুইটি শ্বেতচ্ছত্র ভগবানের মস্তকোপরি ধারণ করে সপরিবার পুষ্পগন্ধাদির দ্বারা পূজা করতে করতে বুদ্ধকে এক একটি বিহারে বিশ্রাম করিয়ে মহাদানাদি কর্ম সম্পাদন করে পাঁচ দিন পর গঙ্গাঁতীরে উপনীত হয়ে সেখানে নৌকা সজ্জিত করে বৈশালী বাসীদের সংবাদ পাঠালেন। তাঁরাও দ্বিগুন পূজা করবে বলে বৈশালী এবং গঙ্গাঁর মাঝখানে ত্রিযোজন ভূমি সমান করে বুদ্ধের উপর চারটি শ্বেতচ্ছত্র এবং অন্যান্য ভিক্ষুদের প্রত্যেকের মাথার উপর দুইট করে শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করে এইগুলো দ্বারা বুদ্ধকে পূজা করার মানসে গঙ্গাঁতীরে উপস্থিত হলেন। রাজা বিম্বিসার দুইটি নৌকা একত্রে বেঁধে তার উপরে মন্ডপ সজ্জিত করে সর্বরতœময় বুদ্ধাসন প্রস্তুত করলেন। বুদ্ধ উক্ত আসনে উপবেশন করলেন। অপরাপর ভিক্ষুগণ বুদ্ধকে ঘিরে উপবেশন করলেন। মহারাজা বিম্বিসার গলঃপ্রমাণ জলে নেমে করজোড়ে বুদ্ধকে বিদায় জানালেন। বুদ্ধ যে কয়দিন রাজগৃহের বাইরে ছিলেন সে কয়দিন বুদ্ধ ফিরে না আসা পর্যন্ত রাজা গঙ্গাঁতীরে অবস্থান করেছিলেন। বুদ্ধ সশিষ্যে বৈশালীতে পদধূলি দিলেন। বুদ্ধ বৈশালীতে পা রাখার সাথে সাথে প্রবল বর্ষণ শুরু হল। রাজা, প্রজা, এবং অমাত্যবর্গ বুদ্ধকে মহাসমারোহে পূজা করলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক শ্রæতিধর এবং ধর্মভান্ডাগারিক আনন্দ স্থবিরকে নগরের চতুর্দিকে রতনসূত্র পাঠ
করতে বললেন। আনন্দ স্থবির নগরীতে পদাচারণ পূর্বক রতন সূত্র পাঠের সাথে সাথে রাজ্যের সর্বপ্রকার উপদ্রব মূহুর্তের মধ্যে বিদূরীত হল এবং বৈশালীবাসীর অন্তহীন দুদর্শা নিবারণ হল। সমগ্র বৈশালীবাসী আনন্দে উদ্বেলিত হল। যেন তাদের পুনঃজন্ম হল। বুদ্ধ বৈশালী থেকে বিদায় নিলেন। বৈশালীবাসী যথাযোগ্য পূজার মাধ্যমে বুদ্ধকে বিদায় জানালেন। এদিকে নাগলোকের মহাঋদ্ধিমান (অলোৗকিক ক্ষমতা সম্পন্ন) নাগেরা চিন্তা করলেন বুদ্ধপূজার এই দূর্লভ সুযোগ তারা হাত ছাড়া করবে না। সাথে সাথে নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ বিমানের (জাহাজের) মত পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফনা বুদ্ধপ্রমূখ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার উপর বিস্তার করল। এইভাবে নাগদের পূজা করতে দেখে দেবলোকের দেবতারা, ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছিলেন। সেই দিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধ্বজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সেই পূজা লাভ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সেই শুভ সন্ধিক্ষণ ছিল শুভ প্রবারণা দিবস। মূলত এই হৃদয়ছোঁয়া চিরভাস্বর স্মৃতিসম্ভারকে অমলিন করে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা দিবসে নিকটবর্তী র্বাঁকখালী নদীতে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত কল্পজাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদযাপন্ করেন। তবে সেইদিন নাগ, দেব, ব্রহ্মা যেভাবে পেরেছিলেন বর্তমান সময়ের মানুষ তা অবিকল পারার কথা নয়। ক্ষেত্র বিশেষে এর বিকৃতি অবস্থাও হয়েছে। তবে এইক্ষেত্রে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, বৌদ্ধ ধর্মে বিনাকারণে কিংবা মনের হরষে আদর্শ উদ্দেশ্য বিনা যেনতেনভাবে কোন উৎসব পালনের বালাই নেই। কেউ করে থাকলে এর দায় কেবল তাদের।কল্পজাহাজ ভাসাই উৎসব এটাকে ধরে রাখতে হবে। এটা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশও বটে। কালে এই উৎসব সার্বজনীন হয়ে ওঠেছে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে এ উৎসব বস্তুত মিলনমেলায় পরিণত হয়। এতে করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্ধেষ ছড়ানোর এই সংকটকালে পারস্পরিক ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার এবং মজবুত করার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়। আমরা আন্তরিকভাবে এও চেষ্টা করে যাচ্ছি যে, এই কল্পজাহাজ ভাসাই উৎসবে কোন ধরণের বিশৃংখলা এবং স্বেচ্ছাচারিতা যা নান্দনিক এই অনুষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে।
শুভ প্রবারণা উপলক্ষে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীকে জানাই মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।
“জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক”
“বাংলাদেশ চিরজীবি হোক”
লেখকঃ সভাপতি, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ।
সম্পাদক, আমাদের রামু ডটকম।